টিন (Tax Identification Number) সার্টিফিকেট হল বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত একটি অনন্য কর সনাক্তকারী নম্বর যার মাধ্যমে করদাতাকে সনাক্ত করা হয়। বর্তমান সময়ে সরকারী ও ব্যাংকিং বিভিন্ন সেবার ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতার অবশ্যই টিন সার্টিফিকেট করার প্রয়োজন হয়। এছাড়াও ব্যবসায়িক লেনদেন, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে চাকরীর ক্ষেত্রে টিন সার্টিফিকেট থাকতে হয়। টিন সার্টিফিকেট না থাকলে অনেক ধরনের সেবা বা আর্থিক কার্যক্রম করা সম্ভব হয় না। কিন্তু অন্যদিক টিন সার্টিফিকেট থাকলে আবার প্রতিবছর রিটার্ন জমার বাধ্যবাধকতা থাকে। করজালে করদাতা আটকে যায়। তাই প্রশ্ন আসতে পারে টিন সার্টিফিকেট এর কী কী সুবিধা অসুবিধা আছে। টিন সার্টিফিকেট এর সুবিধা অসুবিধা যাচাই থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এর প্রয়োজনীয়তা। আপনার প্রয়োজন হলে টিন সার্টিফিকেট নিবেন না হলে নিবেন না।
তবে সকলের জানার আগ্রহের ভিত্তিতে টিন সার্টিফিকেট এর সুবিধা ও অসুবিধা সমূহ আলোচনা করা হলো।
টিন সার্টিফিকেট এর সুবিধা
সহজ ভাষায় বর্তমান সময়ে অধিকাংশ কর্মক্ষেত্রে ও আর্থিক লেনদেনে টিন সার্টিফিকেট এর প্রয়োজন হয়। তাই টিন সার্টিফিকেট ছাড়া আপনি কোন ধরনের কাজই করতে পারবেন না।
আয়কর প্রদানে সুবিধা: টিন সার্টিফিকেট ছাড়া আয়কর প্রদান করা সম্ভব নয়। টিন থাকলে ব্যক্তি সঠিকভাবে আয়কর প্রদান করতে পারেন এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারেন।
আয়ের প্রমাণ: টিন সার্টিফিকেট ব্যক্তির আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। ঋণ গ্রহণ, ব্যাংক হিসাব খোলা, বিদেশ ভ্রমণ ইত্যাদির ক্ষেত্রে আয়ের প্রমাণ হিসেবে টিন সার্টিফিকেট এর প্রয়োজন হয়।
সরকারি সুবিধা ভোগ: অধিকাংশ সরকারী সেবা নিতে হলে টিন সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়। যেমন- জমি কেনা-বেচা, সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ, ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদন নিতে টিন সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়।
ব্যবসায় পরিচালনা: ব্যবসায় পরিচালনায় টিন সার্টিফিকেট একটি আবশ্যকীয় ডকুমেন্ট। টিন সার্টিফিকেট ছাড়া ব্যবসার জন্য ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া সম্ভব না তেমন IRC ERC সনদপ্রাপ্তিও সম্ভব না। ড্রাগ লাইসেন্স, ফায়ার লাইসেন্স, পরিবেশ ছাড়পত্র, বিএসটিআই লাইসেন্স ও ছাড়পত্র প্রাপ্তিতে টিন সার্টিফিকেট প্রয়োজন। আমদানিকারককের ব্যাংকে এলসি খুলতে হলে টিন সার্টিফিকেট দাখিল করতে হয়। কোন কোম্পানী বা ফার্ম কর্তৃক কোন প্রকার পণ্য বা সেবা সরবরাহ গ্রহণকালেও টিন সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়।
ব্যাংকিং সুবিধা: ব্যাংক হিসাব খুলতে টিন সার্টিফিকেট প্রয়োজন না হলেও ব্যাংক হিসাব হতে প্রাপ্ত সুদ হতে যে উৎস কর কর্তন করা হয় টিন সার্টিফিকেট থাকলে ব্যাংক সুদের উপর ৫% কম উৎসে কর কর্তন করে থাকে। এছাড়া ক্রেডিট কার্ড অথবা ব্যাংক হতে ঋণ নিতে হলে টিন সার্টিফিকেট এর কপি ব্যাংকে জমা দিতে হয়। সঞ্চয়পত্র ক্রয়েও টিন সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়।
পেশাজীবী সংস্থার সদস্যপদ প্রাপ্তি: চিকিৎসক, দন্ত চিকিৎসক, আইনজীবী, চার্টার্ড একাউন্টেন্ট, কস্ট এন্ড ম্যানেজমেন্ট একাউন্টেন্ট, প্রকৌশলী, স্থপতি অথবা সার্ভেয়ার হিসেবে বা সমজাতীয় পেশাজীবী হিসেবে বা কোন স্বীকৃত পেশাজীবী সংস্থার সদস্যপদ পেতে হলে টিন সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়।
বেতন প্রাপ্তি: আপনি হয়তো কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন কিন্তু মাস শেষে বেতন পাবেন না যদি না টিন সার্টিফিকেট না থাকে। তবে সবার জন্য এই আইন প্রযোজ্য নয়। ব্যবস্থাপনা বা প্রশাসনিক বা উৎপাদন কার্যক্রমের তত্ত্বাবধানকারী অবস্থানে কর্মরত ব্যক্তি, গণকর্মচারী, মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার বা এমপিও ভূক্তি শিক্ষক যাদের সরকারের নিকট হতে মাসিক ১৬,০০০ টাকার উর্ধে কোন আর্থিক সুবিধা নিয়ে থাকেন তাদের সকলেরও টিন সার্টিফিকেট থাকতে হবে।
টিন সার্টিফিকেট এর অসুবিধা
টিন সার্টিফিকেট থাকলে আইনগত অনেকগুলো বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাই টিন সার্টিফিকেট থাকার কিছু অসুবিধা আছে।
রিটার্ন জমার বাধ্যবাধকতা: টিন সার্টিফিকেট থাকলে ট্যাক্স থাকুক বা না থাকুক তাকে প্রতিবছর রিটার্ন জমা দিতে হবে। আয়কর রিটার্ন তৈরি করার ক্ষেত্রে কিছু আইনগত জটিলতা আছে। তাই এক্ষেত্রে দক্ষ আয়কর পরামর্শকের পরামর্শ নিতে হবে।
করের বোঝা: যেহেতু প্রতিবছর আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হবে তাই আয়ের বিপরীতে আইনগতভাবে করের টাকাও সরকারী কোষাগারে জমা দিতে হবে। (যাদের আয় নেই তাদের অবশ্য কর নাই) আর আয়করের আইন অনুযায়ী যাদের আয় বেশি তাদের করের হারও বেশি। তাই যত বেশি আয় তত বেশি করের বোঝা।
ভুল রিটার্নে জরিমানা: অনেকেই না বুঝে নিজেই নিজের রিটার্ন জমা দেন। যেই রিটার্নে আয়-ব্যয়-সম্পদ-দায়ের হিসাব সঠিকভাবে না থাকায় আয়করের অডিটের সম্মুখীন হতে হয় এবং পরবর্তীতে বড় অংকের করদায় তৈরির সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
সম্পদ ও আয়ের তথ্য প্রকাশ: করদাতা যখন রিটার্ন জমা দেয় তখন রিটার্নে সম্পদ-দায়, আয়ের তথ্য দিতে হয়। বর্তমান আইন অনুযায়ী ৪৩টি সেবার ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দাখিল করতে হয়। রিটার্নে দাখিলের প্রমাণপত্রে করদাতার আয় ও করের পরিমাণ উল্লেখ থাকে তাই যার নিকট এই রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দাখিল করা হচ্ছে সে করদাতার আয় সম্পর্কে ধারণা পেয়ে যাচ্ছে।
শেষকথা
টিন সার্টিফিকেট একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। তাই এর সুবিধা-অসুবিধা থেকে এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানা দরকার। অনেকেই আছে যারা অপ্রয়োজনে টিন সার্টিফিকেট খুলে ফেলে। যার জন্য পরবর্তীতে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তাই আমার ব্যক্তিগত মতামত থাকবে, টিন সার্টিফিকেট যদি আপনার দরকার না হয় তাহলে অযথা আপনি আপনার টিন সার্টিফিকেট তৈরি করতে করবেন। কারণ, একজন ব্যক্তির নামে একবারই টিন সার্টিফিকেট করা যায় এবং একবার টিন সার্টিফিকেট করলে আপনাকে আয়করের আইনগত বিষয়গুলো মেনে চলতে হবে। তাছাড়া টিন সার্টিফিকেট বাতিল করার প্রক্রিয়াটা সহজ নয়।