Bangladesh shifts to crawling peg system

বাংলাদেশ ব্যাংক টাকার মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে ক্রলিং পেগ নীতি প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করলেও বাংলাদেশে এইপ্রথমবারের মতো সূচনা করা হলো। তাই আজকে আমরা জানবো ক্রলিং পেগ কি, কিভাবে কাজ করে, এর সুবিধা ও অসুবিধা এবং বাংলাদেশে এই পদ্ধতি কতটুকু কার্যকর হবে।

ক্রলিং পেগ কী?
কিভাবে ক্রলিং পেগ কাজ করে?
ক্রলিং পেগ এর সুবিধা ও অসুবিধা
বাংলাদেশের জন্য ক্রলিং পেগ কতটা কার্যকর হবে?

ক্রলিং পেগ কী?

ক্রলিং পেগ হলো এক ধরণের এক্সচেঞ্জ রেট ব্যবস্থা যা fixed and floating, এই দুই রকম এক্সচেঞ্জ রেটের মিশ্রণ, যেখানে একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি নির্দিষ্ট “মিড-রেট” বা “কেন্দ্রীয় মূল্য” নির্ধারণ করে। এই মিড-রেটের চারপাশে একটি নির্দিষ্ট “ব্যান্ড” বা “সীমা” নির্ধারণ করা হয়। বাজারে ডলারের চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে মিড-রেটের উপরে বা নিচে ডলারের দাম দৈনিক একটু একটু করে সমন্বয় করা হয়।

কিভাবে ক্রলিং পেগ কাজ করে?

ক্রলিং পেগ এর মাধ্যমে কিভাবে বৈদেশিক মুদ্রার হার নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তা নিচের আমরা পয়েন্ট আকারে সহজ ভাষায় বর্ণনা করেছি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি রেফারেন্স হার নির্ধারণ করে: প্রথমে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি রেফারেন্স হার নির্ধারণ করে, যা সাধারণত একটি বড় অর্থনীতির মুদ্রার বিরুদ্ধে স্থির করা হয় (যেমন, মার্কিন ডলার বা ইউরো)।

বাজারে হস্তক্ষেপ: রেফারেন্স হারের চেয়ে বেশি বা কম হলে বিনিময় হার বাজারে হস্তক্ষেপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে।

মুদ্রা কেনা বা বিক্রি: যদি বিনিময় হার রেফারেন্স হারের চেয়ে বেশি হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে স্থানীয় মুদ্রা কিনে বিনিময় হার কমিয়ে দেয়। অন্যদিকে, যদি বিনিময় হার রেফারেন্স হারের চেয়ে কম হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে স্থানীয় মুদ্রা বিক্রি করে বিনিময় হার বাড়িয়ে দেয়।

হার সময়ের সাথে সাথে সমন্বয় করা হয়: সময়ের সাথে সাথে, মুদ্রাস্ফীতি, সুদের হার এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক বিষয়গুলির পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে রেফারেন্স হার এবং/অথবা বিনিময় হারের ব্যান্ড সমন্বয় করা যেতে পারে।

ক্রলিং পেগ এর সুবিধা ও অসুবিধা

ক্রলিং পেগ পদ্ধতি সুবিধা ও অসুবিধা দুইটায় রয়েছে। এটি কতটুকু ফলপ্রসু হবে তা অনেকটায় নির্ভর করছে নীতি নির্ধারকরা কিভাবে এটি প্রয়োগ করতে পারে তার উপর।

ক্রলিং পেগ এর সুবিধা

১. মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ: বৈদেশিক মুদ্রার সাথে স্থানীয় মুদ্রার মূল্য স্থির রাখার মাধ্যমে, ক্রলিং পেগ ব্যবস্থা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। আমদানি পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা রক্ষা করতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

২. বৈদেশিক বাণিজ্য সহজতর করে: স্থিতিশীল বিনিময় হার ব্যবসায়ীদের জন্য আমদানি ও রপ্তানি সহজ করে তোলে। এটি ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তা কমায় এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রসারিত করতে সহায়তা করে।

৩. বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করে: স্থিতিশীল মুদ্রা বিনিময় হার বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় পরিবেশ তৈরি করে। কারণ, বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগের মূল্য স্থিতিশীল থাকবে বলে আশা করতে পারেন।

৪. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি করে: উপরে বর্ণিত সুবিধাগুলি মিলিতভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। স্থিতিশীল মুদ্রা ব্যবস্থা বিনিয়োগ, ব্যবসা ও ভোগপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি করে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে।

৫. আর্থিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করে: ক্রলিং পেগ ব্যবস্থা বাজারে অনিশ্চয়তা কমিয়ে আর্থিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। এটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং বিনিয়োগের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে।

৬. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল করে: ক্রলিং পেগ ব্যবস্থার অধীনে, সরকার বাজারে হস্তক্ষেপ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে পারে। যখন স্থানীয় মুদ্রার চাহিদা বেশি থাকে, তখন সরকার বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রি করে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ করে। অন্যদিকে, যখন স্থানীয় মুদ্রার চাহিদা কম থাকে, তখন সরকার বৈদেশিক মুদ্রা কিনে বাজার থেকে মুদ্রা প্রত্যাহার করে।

ক্রলিং পেগ এর অসুবিধা

১. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর চাপ: যদি টাকার চাহিদা ডলারের চাহিদার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংককে বাজারে টাকা সরবরাহ করতে হবে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যেতে পারে। বিশেষ করে, যদি টাকার মূল্য স্থির রাখার জন্য ব্যাংককে বাজারে প্রচুর পরিমাণে ডলার কিনতে হয়, তাহলে ব্যাংকের ডলার রিজার্ভ দ্রুত কমে যেতে পারে দীর্ঘমেয়াদে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেলে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন হতে পারে।

২. মানুষের আয়ের উপর নেতিবাচক প্রভাব: যদি টাকার মূল্য ডলারের বিপরীতে ক্রমশ হ্রাস পায়, তাহলে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। কারণ, আমদানিকারকদের ডলার কিনতে বেশি টাকা দিতে হবে। এর ফলে, খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধের মতো প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে, সাধারণ মানুষের আয়ের ক্রয়ক্ষমতা কমে যেতে পারে এবং তাদের জীবনযাত্রার মানের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

৩. অর্থনৈতিক নমনীয়তা হ্রাস: স্থির মুদ্রা বিনিময় হার দেশকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ঝড়ের প্রতি বেশি সংবেদনশীল করে তুলতে পারে। কারণ, মুদ্রা স্থিতিশীল রাখার জন্য নীতি নির্ধারকদের অন্যান্য নীতিগত সরঞ্জাম ব্যবহারের সুযোগ কম থাকে।উদাহরণস্বরূপ, যদি বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেয় এবং অন্যান্য দেশ তাদের মুদ্রার মূল্য কমিয়ে দেয়, তাহলে বাংলাদেশের পক্ষে তার মুদ্রার মূল্য কমিয়ে দেওয়া কঠিন হতে পারে। এর ফলে, বাংলাদেশের রপ্তানি কমে যেতে পারে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে।

৪. দুর্নীতির ঝুঁকি বৃদ্ধি: ক্রলিং পেগ ব্যবস্থায়, বাজারে হস্তক্ষেপ করার জন্য সরকারের কাছে ব্যাপক ক্ষমতা থাকে। এই ক্ষমতা অপব্যবহারের ফলে দুর্নীতির ঝুঁকি বৃদ্ধি পেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংক কর্মকর্তারা ব্যক্তিগত লাভের জন্য বাজারে হস্তক্ষেপ করতে পারেন। এর ফলে, সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ হতে পারে এবং অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

বাংলাদেশের জন্য ক্রলিং পেগ কতটা কার্যকর হবে?

বাংলাদেশের জন্য ক্রলিং পেগ কতটা কার্যকর হবে তা নির্ভর করে বিভিন্ন বিষয়ের উপর, যার মধ্যে রয়েছে:

১) বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি: যদি বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়, তাহলে টাকার উপর চাপ বৃদ্ধি পেতে পারে এবং ক্রলিং পেগ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা কঠিন হতে পারে। অন্যদিকে, যদি বৈশ্বিক অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকে, তাহলে টাকার মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হবে এবং ক্রলিং পেগ ব্যবস্থা কার্যকর হতে পারে।

২) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতি: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পেলে ডলারের মূল্য কমে যাবে এবং টাকার উপর চাপ বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতি কমে গেলে ডলারের মূল্য বেড়ে যাবে এবং টাকার উপর চাপ কমে যাবে।

৩) বাংলাদেশের রপ্তানি: যদি বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধি পায়, তাহলে ডলারের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে এবং টাকার মূল্য স্থিতিশীল থাকতে সাহায্য করবে। অন্যদিকে, যদি বাংলাদেশের রপ্তানি কমে যায়, তাহলে ডলারের চাহিদা কমে যাবে এবং টাকার উপর চাপ বৃদ্ধি পাবে।

৪) বাংলাদেশের রেমিট্যান্স: প্রবাসী বাংলাদেশীদের রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেলে ডলারের সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে এবং টাকার মূল্য স্থিতিশীল থাকতে সাহায্য করবে। অন্যদিকে, প্রবাসী বাংলাদেশীদের রেমিট্যান্স কমে গেলে ডলারের সরবরাহ কমে যাবে এবং টাকার উপর চাপ বৃদ্ধি পাবে।

৫) বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ: বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ যত বেশি হবে, টাকার মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা তত সহজ হবে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ যত কম হবে, টাকার উপর চাপ বৃদ্ধি পাবে এবং ক্রলিং পেগ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা কঠিন হতে পারে।

শেষকথা

    ক্রলিং পেগ ব্যবস্থা বাংলাদেশের জন্য কতটা কার্যকর হবে তা নির্ভর করবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতি, বাংলাদেশের রপ্তানি ও রেমিট্যান্স এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের উপর। এই সকল বিষয়গুলো বিবেচনা করে দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন।

    About The Author

    Leave a Reply