প্রত্যেক করদাতাকে প্রতিবছর তাদের আয়কর রিটার্ন সংশ্লিষ্ট সার্কেলে জমা দিতে হয়। আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার পর অনেক সময় করদাতাদের রিটার্ন অডিটের মুখোমুখি হতে হয়। অডিটের মাধ্যমে কর কর্তৃপক্ষ করদাতার আয়ের তথ্য যাচাই করে এবং যদি কোনো অসঙ্গতি দেখা যায়, তাহলে করদাতাকে অতিরিক্ত কর দিতে হতে পারে। এছাড়াও জরিমানা ও অন্যান্য জটিলতার সম্মুখীন হতে হতে পারে। তাই আমাদের জানা দরকার কী কী কারণে আয়কর রিটার্ন অডিটে পরতে পারে।
আয়কর রিটার্ন অডিটে পরার কারণ
আয়কর রিটার্ন অডিটে পড়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে কিছু সাধারণ কারণ আমরা এই লেখায় আলোচনা করলাম।
১. আয়কর গণনায় ভুল
অনেক করদাতা তাদের আয়ের সঠিক হিসাব না করে আয়কর রিটার্ন জমা দেন, যার ফলে কর কর্তৃপক্ষের কাছে কম আয় দেখানো হয় এবং কম কর প্রদান করা হয়। এর মধ্যে কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের করযোগ্য আয়ের কিছু অংশ বাদ দিয়ে থাকেন, যা আয়কর কম হিসাব করার কারণ। এছাড়াও, অনেক করদাতা ভুল কর হার প্রয়োগ করে থাকেন, যার ফলে ভুল পরিমাণে আয়কর প্রদান করা হয়। এই ধরণের ভুলের ফলে কর ফাঁকি পরিলক্ষিত হয় এবং করদাতা জরিমানার সম্মুখিন হতে পারে।
২. ব্যাংক সুদ হিসাব ভুক্ত না করা
আয়কর আইন অনুসারে, সকল আয়ের উপর আয়কর প্রযোজ্য, তা সঞ্চয়পত্র, এফডিআর সুদ, বা অন্য যেকোনো উৎস থেকে আসুক না কেন। তাই, আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় এই আয়গুলো গোপন করলে, বা বাদ দিলে, রিটার্নটি অডিটে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
৩. তথ্যের অসঙ্গতি
আয়কর রিটার্ন অডিটের পড়ার একটি প্রধান কারণ হল আইটি ১০বি তে প্রদত্ত তথ্যের সাথে রিটার্নের অন্যান্য তথ্যের অমিল। উদাহরণস্বরূপ, যদি আইটি ১০বি তে প্রদত্ত আয়ের পরিমাণ রিটার্নে প্রদত্ত আয়ের পরিমাণের সাথে মেলে না, তাহলে কর কর্মকর্তা রিটার্নটি অডিটের জন্য নির্বাচন করতে পারেন।
অডিটের আরেকটি সাধারণ কারণ হল সমর্থনকারী কাগজপত্রের সাথে তথ্যের অমিল। করদাতাদের আয়ের উৎস, খরচ, এবং কর ছাড়ের দাবির প্রমাণ জমা দিতে হয়। যদি এই কাগজপত্রের তথ্য রিটার্নে প্রদত্ত তথ্যের সাথে মেলে না, তাহলে রিটার্নটি অডিটের জন্য নির্বাচিত হতে পারে।
৪. প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা না দেওয়া
আয়কর রিটার্ন দাখিল করার সময় সঠিকভাবে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- বেতন বিবরণী, ব্যাংক বিবরণী, সম্পত্তির কাগজপত্র ইত্যাদি না থাকলে রিটার্নটি অডিটে পড়ে যেতে পারে।
৫. কৃষি জমিতে আয় না দেখানো
অনেকসময় করদাতা রিটার্নের আইটি-১০বি তে কৃষি জমির পরিমাণ উল্লেখ করেন। কিন্তু উক্ত জমিতে কোন আয় দেখান না। স্বাভাবিক ভাবেই কোন কৃষি জমি থাকলে উক্ত জমি অব্যবহৃত থাকে না। হয় জমির মালিক নিজে কৃষি কাজ করেন অথবা অন্য কারো নিকট জমি বর্গা দেন। নিজে কৃষি কাজ বা জমি বর্গা যেভাবেই হোক কৃষি জমি হতে কৃষি আয় হয়। যদি এমনটি হয় যে করদাতা কৃষি জমিতে কোন আয়ই রিটার্নে দেখান নাই, তাহলে তার রিটার্ন অডিটে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
৬. গাড়ি খরচের অসঙ্গতি
যদি দেখা যায় যে আপনার আয়ের তুলনায় অতিরিক্ত গাড়ি খরচ দেখানো হয়েছে, তাহলে আপনার রিটার্ন অডিটে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অডিটে পড়ার ঝুঁকি কমাতে, আপনার গাড়ি খরচের জন্য যথাযথ প্রমাণ সংগ্রহ করে রাখা উচিত। এর মধ্যে গাড়ির কাগজপত্র, রিপেয়ার ও রক্ষণাবেক্ষণের বিল, জ্বালানি খরচের রসিদ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও, আপনার গাড়ি ব্যবহারের উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে প্রস্তুত থাকা উচিত।
৭. বাড়ি নির্মাণ ব্যয়ের অসঙ্গতি
প্রথমত, আপনার আয়ের উৎস এবং পরিমাণের সাথে আপনার বাড়ি নির্মাণের খরচের মিল থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, আপনার বাড়ি নির্মাণের খরচের সাথে Pwd রেটের সামঞ্জস্য থাকতে হবে। আপনি যদি গৃহঋণ নিয়ে বাড়ি নির্মাণ করেন তাহলে গৃহঋণের সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস জমা দিতে হবে। যদি এসকল তথ্যের গরমিল দেখা দেয় তাহলে আপনার আয়কর রিটার্নটি অডিটে পড়তে পারে।
৮. বিনিয়োগের সমর্থনকারী কাগজপত্র না থাকা
বিনিয়োগের সমর্থনকারী কাগজপত্র যেমন ফিক্সড ডিপোজিট রিসিট (FDR), শেয়ারের সার্টিফিকেট, ইত্যাদি না থাকলে আয়কর রিটার্ন অডিটে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কারণ, আয়কর কর্তৃপক্ষ বিনিয়োগের বৈধতা যাচাই করতে এবং করদাতার আয়ের সঠিক উৎস নির্ণয় করতে এই কাগজপত্রগুলি পর্যালোচনা করে।
৯. আয়কর রেয়াত গণনায় ভুল
করদাতা কয়েকটি নির্ধারিত খাতে বিনিয়োগ করে নির্ধারিত পরিমাণ আয়কর রেয়াত নিতে পারেন যা তার মোট প্রদেয় করের পরিমাণকে হ্রাস করে। কিন্তু যদি কোন করদাতা আয়কর রেয়াত গণনায় ভুল করে অথবা রেয়াতের সমর্থনকারী কাগজপত্র রিটার্নের সহিত না জমা দেয় তাহলে তার রিটার্নটি ডিসিটি অডিটের আওতায় নিয়ে যেতে পারে।
১০. পারিবারিক খরচ তুলনামূলক কম
আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার সময়, আপনার আয়ের তুলনায় পারিবারিক খরচ অস্বাভাবিক কম দেখানো হলে আপনার রিটার্ন অডিটে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ আয়কর কর্তৃপক্ষ ধারণা করে যে, একজন ব্যক্তির আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য ব্যয় হবে। যদি খরচ আয়ের তুলনায় অনেক কম দেখানো হয়, তাহলে কর্তৃপক্ষ মনে করতে পারে যে, আয় গোপন করা হচ্ছে।
১১. ব্যাংকিং চ্যানেল ছাড়া লেনদেন
ব্যক্তিগত করদাতাদের জন্য, ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যতীত সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দান গ্রহণ করা যায়। একইভাবে, ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রেও ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যতীত সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত লেনদেন করা সম্ভব। অন্যদিকে, কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে সকল প্রকার আয় ও প্রাপ্তি এবং প্রত্যেক একক লেনদেনে ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকার অধিক ও বার্ষিক সর্বমোট ৩৬ (ছত্রিশ) লক্ষ টাকার উর্ধ্বে সকল প্রকার ব্যয় ও বিনিয়োগ ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে। উল্লেখ্য, উপরোক্ত বিধানগুলো অমান্য করলে রিটার্ন অডিটে পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
১২. ভুলভাবে কর ফেরত দাবী করলে
অনেক করদাতা আছেন যারা কোন করবর্ষে অতিরিক্ত কর পরিশোধ করে থাকেন। এই অতিরিক্ত পরিশোধকৃত কর পরবর্তী বছরের প্রদেয় করের সাথে সমন্বয় করা সম্ভব। তবে, রিটার্নে ভুলভাবে কর ফেরত দাবি করলে অথবা Refundable tax সমন্বয় বা প্রত্যর্পন দাবী করলে রিটার্ন অডিটে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কারণ, কর কর্তৃপক্ষ করদাতার কর ফেরত দাবীর বিপরীতে করদাতার আয়, কর ছাড়, এবং অন্যান্য তথ্য যাচাই করবে। যদি কর কর্তৃপক্ষ দেখতে পায় যে করদাতা ভুলভাবে কর ফেরত দাবি করেছে, তাহলে করদাতাকে অতিরিক্ত কর, জরিমানা দিতে হতে পারে।
আমাদের শেষকথা
আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন করা এবং সঠিক তথ্য প্রদান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উপরে উল্লেখিত কারণগুলো ছাড়াও আরও কিছু কারণে রিটার্ন অডিটে পড়তে পারে। তাই, রিটার্ন জমা দেওয়ার আগে একজন অভিজ্ঞ কর বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে নেওয়া উচিত অথবা আপনি রিটার্ন অডিটের ঝুঁকি কমানোর উপায় সম্পর্কে আমাদের লেখা প্রবন্ধটি পড়তে পারেন। রিটার্ন পূরণে কোন ভুল থাকলে তা সংশোধন করে সঠিকভাবে রিটার্ন জমা দেওয়া উচিত। এতে করে রিটার্ন অডিটে পড়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
প্রতিটা করদাতার জন্য এই লেখাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই আপনার পরিচিত সকলের নিকট এই লেখাটা শেয়ার করে আয়কর রিটার্ন অডিটে পড়ার ঝুঁকি থেকে নিরাপদ থাকুন।