Private Employee Salary Income Tax

বর্তমান আয়কর আইনে চাকরিজীবীদের প্রতিবছর আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। তাই আমরা চাকরিজীবীদের আয়কর নির্ণয়ের পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।

আয়কর রিটার্ন সহজে প্রস্তুত করার জন্য প্রতিবছর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আয়কর নির্দেশিকা প্রকাশ করে থাকে যেখানে উদাহরণসহ আয়কর নির্ণয়ের পদ্ধতি আলোচনা করা হয়। চাকরিজীবীদের আয়কর নির্ণয়ের জন্য আয়কর আইনে ধারা ৩২, ধারা ৩৩, ধারা ৩৪, ধারা ৭৮ এবং ষষ্ট তফসিলের অংশ ১ ও অংশ ৩ দেখতে হবে। আইনের ভাষা কিছুটা জটিল যা একটি করদাতার জন্য ব্যাখা করা তুলনামূলক কঠিন কাজ। তাই এই লেখায় আমরা চাকরিজীবীদের আয়কর নির্ণয়ের পদ্ধতিটি সহজ ও সরলভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব। আমরা জানব, কীভাবে বেসরকারি চাকরিজীবীদের আয় নির্ধারণ করা হয়, করযোগ্য আয় এবং কর অব্যাহতির সুযোগ সম্পর্কে।

চাকরি হতে আয়ের ধরণ

চাকরি থেকে প্রাপ্ত আয় বলতে বিভিন্ন উৎস থেকে আয় অন্তর্ভুক্ত হয়। একজন চাকরিজীবী শুধু বেতনই পান না, বরং বিভিন্ন ভাতা, কমিশন, বোনাস, এবং অন্যান্য সুবিধা পান। তাই আয়কর আইন অনুযায়ী, বেসরকারি চাকরিজীবীদের আয় গণনা করার সময় নিম্নলিখিত আয়গুলিকে করযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়:

  • বেতন, মজুরি, পারিশ্রমিক
  • ভাতা, ছুটি ভাতা, বোনাস, ফি, কমিশন
  • অগ্রিম বেতন
  • আনুতোষিক, পেনশন
  • চাকরির অবসানের কারণে প্রাপ্ত ক্ষতিপূরণ
  • ভবিষ্যত তহবিল বা অন্য কোনো তহবিলে কর্মচারীর অনুদানের অংশ ব্যতীরেকে অবশিষ্ট অংশ
  • চাকরির চুক্তির শর্তাবলির পরিবর্তনের ফলে প্রাপ্ত অঙ্ক বা সুবিধাদি
  • চাকরিতে যোগদানকালে বা চাকরির অন্য কোনো শর্তের অধীন প্রাপ্ত অঙ্ক বা সুবিধাদি
  • পারকুইজিট
  • কর্মচারী শেয়ার স্কিম হইতে অর্জিত আয়
  • কর অনারোপিত বকেয়া বেতন

পারকুইজিট, ভাতা ও সুবিধাদির আর্থিক মূল্য নির্ধারণ

পারকুইজিট বলতে এমন কিছু সুবিধা বোঝায়, যা একজন কর্মচারী তার নিয়োগকর্তার কাছ থেকে সরাসরি নগদ নয়, কিন্তু নানান ধরনের সুবিধা বা সুযোগ হিসেবে পান। এই ধরনের সুবিধা প্রায়শই করযোগ্য হয়ে থাকে।

ক্রমিক নংপারকুইজিট, ভাতা, সুবিধা, ইত্যাদিনির্ধারিত মূল্য
আবাসন সুবিধাক)  আবাসনের ভাড়া সম্পূর্ণভাবে নিয়োগকর্তা কর্তৃক পরিশোধিত হলে অথবা নিয়োগকর্তা কর্তৃক আবাসনের ব্যবস্থা করা হলে আবাসনের বার্ষিক মূল্য;
খ) হ্রাসকৃত ভাড়ায় প্রাপ্ত আবাসনের ক্ষেত্রে অনুচ্ছেদ (ক) অনুযায়ী নির্ধারিত ভাড়া এবং পরিশোধিত ভাড়ার পার্থক্য।
মোটরগাড়ি প্রতি সুবিধাক)  ২৫০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ির ক্ষেত্রে মাসিক ১০ (দশ) হাজার টাকা;
খ)  ২৫০০ সিসির অধিক এইরূপ গাড়ির ক্ষেত্রে মাসিক ২৫ (পঁচিশ) হাজার টাকা।
অন্য কোনো পারকুইজিট, ভাতা বা সুবিধাপারকুইজিট, ভাতা বা সুবিধার আর্থিক মূল্য বা ন্যায্য বাজার মূল্য।

শেয়ার স্কিম

কিছু কোম্পানি কর্মচারীদের শেয়ার কেনার সুযোগ দেয়। যখন কর্মচারী এই শেয়ারগুলো পান, তখন শেয়ারের ন্যায্য বাজার মূল্য আয় হিসেবে যোগ করা হয়। শেয়ার বিক্রির সময়ও সেই আয় করযোগ্য হয়।

করমুক্ত আয়

নিয়োগকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত কিছু সুবিধা চাকরীজীবীর করযোগ্য মোট আয় পরিগণনায় বিবেচ্য হবে না। যেমন:-

  • শেয়ারহোল্ডার পরিচালক নহে এইরূপ অন্য কোনো কর্মচারীর হার্ট, কিডনি, চক্ষু, লিভার ও ক্যানসার অপারেশন সংক্রান্ত চিকিৎসা ব্যয় বাবদ প্রাপ্ত অর্থ  
  • সম্পূর্ণরূপে এবং কেবল চাকরির দায়িত্ব পরিপালনের জন্য প্রাপ্ত এবং ব্যয়িত যাতায়াত ভাতা, ভ্রমণ ভাতা ও দৈনিক ভাতা
  • ভবিষ্যত তহবিল, অনুমোদিত বার্ধক্য তহবিল, পেনশন তহবিল এবং অনুমোদিত আনুতোষিক তহবিল হইতে কর্মচারী বা নিয়োগকর্তা হইতে গৃহীত কোনো চাঁদা হইতে উহাদের সুবিধাভোগীদের মাঝে বিতরণকৃত আয়। তবে শর্ত থাকে যে, কোনো অনুমোদিত আনুতোষিক তহবিল হইতে করদাতা কর্তৃক আনুতোষিক হিসাবে গৃহীত অর্থ অনধিক ২ (দুই) কোটি ৫০ (পঞ্চাশ) লক্ষ টাকার সীমা অতিক্রম করিবে না।
  • পেনশনারস সেভিংস সার্টিফিকেট হইতে সুদ
  • কোন নিয়োগকর্তা কর্তৃক কোন কর্মচারীর ব্যয় পুনর্ভরণ যদি-
    • উক্ত ব্যয় সম্পূর্ণভাবে এবং আবশ্যকতা অনুসারে কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সূত্রে ব্যয়িত করা হয়
    • নিয়োগকারীর জন্য উক্ত কর্মচারীর মাধ্যমে এইরূপ ব্যয় নির্বাহ সর্বাধিক সুবিধাজনক ছিল

চাকরি হতে আয় পরিগণনার নিয়ম

নতুন আয়কর আইনে চাকরি হতে আয় পরিগণনার হিসাবটা সহজ করা হয়েছে। চাকরি হতে আয়ের এক-তৃতীয়াংশ বা ৪ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা যাহা কম হবে তাহা চাকরি হতে আয় হতে বিয়োগ করে করযোগ্য আয় নির্ণয় করতে হবে।

উদাহরণস্বরূপ: মি. রহমানের যদি বছরে ১৫ লক্ষ টাকা আয় হয়, তাহলে তার করযোগ্য আয় হবে ১৫,০০,০০০/৩ = ৫ লক্ষ টাকা। যেহেতু ৪,৫০,০০০ টাকার বেশি ৫ লক্ষ টাকা, তাই তার মোট আয় থেকে ৪.৫ লক্ষ টাকা বিয়োগ হবে। ফলে, তার করযোগ্য আয় হবে ১৫ লক্ষ – ৪.৫ লক্ষ = ১১.৫ লক্ষ টাকা। এখন এই ১১.৫ লক্ষ টাকার উপর প্রযোজ্য কর নির্ধারণ করা হবে।

আয়কর হার ২০২৪-২০২৫ অনুযায়ী মি. রহমানের আয়করের পরিমাণ হবে:

প্রথম, ৩,৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত শুন্য
পরবর্তী ১,০০,০০০ টাকার জন্য ১,০০,০০০ X ৫% = ৫,০০০ টাকা
পরবর্তী ৪,০০,০০০ টাকার জন্য ৪,০০,০০০ X ১০% = ৪০,০০০ টাকা
পরবর্তী ২,৫০,০০০ টাকার জন্য ২,৫০,০০০ X ১৫% = ৩৭,৫০০ টাকা
সর্বমোট করদায় ৮২,৫০০ টাকা।

আয়কর নির্নয়ের করহার জানতে আপনি আয়কর হার ২০২৪-২০২৫ সম্পর্কে জানতে হবে।

এছাড়াও একজন চাকরীজীবী তার চাকরীর আয়ের পাশাপাশি বাড়ীভাড়া, ব্যাংক সুদ ও সঞ্চয়পত্র সুদসহ আরও অন্যান্য উৎস হতে আয় করতে পারেন। যা তার আয়ের সাথে যোগ করতে হবে। তবে ব্যাংক সুদ ও সঞ্চয়পত্র সুদ নূন্যতম কর হওয়াতে এই দুইটির বা নূন্যতম করের আওতায় কোন আয় হতে উক্ত আয় হতে উৎসে কর্তনকৃত কর স্বাভাবিক আয়ের সাথে যোগ হবে।

তবে করদাতা যদি জাতীয় রাজস্ববোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত খাতে সংশ্লিষ্ট অর্থবছরে কোন বিনিয়োগ করে উক্ত বিনিয়োগের জন্য কর রেয়াত সুবিধা পাবেন।

উদাহরণস্বরুপ: মি. রহমান উক্ত অর্থ বছরে ১,০০,০০০ টাকার সঞ্চয়পত্র ক্রয় করেন, ব্যাংকে মাসিক ৫,০০০ টাকার ডিপিএস করেন এবং ১২ মাসেই ডিপিএসের টাকা জমা করেন। তাহলে তার মোট বিনিয়োগের পরিমাণ,
সঞ্চয়পত্র = ১,০০,০০০ টাকা
ডিপিএস = ৫,০০০ X ১২ = ৬০,০০০ টাকা
সর্বমোট = ১,০০,০০০ + ৬০,০০০ = ১,৬০,০০০ টাকা।

কর রেয়াত নির্ণয়ের সূত্র অনুযায়ী,
বিনিয়োগের ১৫%; ১,৬০,০০০ X ১৫% = ২৪,০০০ টাকা
বা মোট করযোগ্য আয়ের ৩% অর্থ্যাৎ, ১১,৫০,০০০ X ৩% = ৩৪,৫০০ টাকা
বা ১০,০০,০০০ টাকা।
এই ৩টির ভিতর ২৪,০০০ টাকা সর্বনিম্ন হওয়ায়, কর রেয়াতের পরিমাণ হবে ২৪,০০০ টাকা।

মি. রহমানের কর রেয়াত প্রাপ্তির পরে মোট করের পরিমাণ হবে = ৮২,৫০০ – ২৪,০০০ = ৫৮,৫০০ টাকা।

শেষ কথা

বেসরকারি চাকরিজীবীদের আয় করের আওতায় আসার পরিমাণ এবং সুযোগ সুবিধার হিসাব অনেক সহজ হলেও, এর বিস্তারিত বোঝাপড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি আয়কর নির্দেশিকা এবং এই প্রবন্ধ পড়েও আয়কর রিটার্ন পূরণে জটিলতা মনে করে তাহলে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ আয়কর আইনজীবির পরামর্শ নিবেন। কারণ, কোন কারণে ভুলভাবে আয়কর রিটার্ন জমা দিলে পরবর্তী আপনাকে অনেক জটিলতার সম্মুখীন হওয়া লাগতে পারে।

আয়কর সম্পর্কে আরও বিভিন্ন বিষয়ে জানতে এইখানে ক্লিক করুন। এছাড়া আয়কর সম্পর্কে আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করুন অথবা আমাদের ফেসবুক পেজ এ মেসেজ করুন।

About The Author

Leave a Reply

× Contact Support!