ব্যাংকে স্বতন্ত্র পরিচালক: কারা, কেন এবং কীভাবে?

independent director in bank

ব্যাংক-কোম্পানীতে “স্বতন্ত্র পরিচালক” নিয়োগ এবং তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং সম্মানি প্রসঙ্গে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক জারি করা বিআরপিডি সার্কুলার নং-০৩ ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই লেখায় ব্যাংকে নিয়োগপ্রাপ্ত স্বতন্ত্র পরিচালক কারা হবেন, পরিচালক সংখ্যা, পরিচালকদের নিয়োগ মেয়াদ, পরিচালকদের দায়িত্ব, কর্তব্য ও জরিমানা সম্পর্কে নীতিমালাসমূহ আলোচনা করা হয়েছে।

স্বতন্ত্র পরিচালক কারা?

স্বতন্ত্র পরিচালক বলতে বোঝায় এমন ব্যক্তি যিনি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা ও শেয়ারধারকদের থেকে স্বাধীন এবং কেবল ব্যাংকের স্বার্থে মতামত প্রদান করেন। ব্যাংক-কোম্পানী আইন, ১৯৯১ অনুসারে, ব্যাংকের সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। স্বতন্ত্র পরিচালকের ব্যাংক বা ব্যাংকের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তির সাথে অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যতের কোনো প্রকৃত বা দৃশ্যমান স্বার্থের সম্পর্ক নেই।

স্বতন্ত্র পরিচালক সংখ্যা

ব্যাংক কোম্পানী আইন, ১৯৯১ অনুসারে, একটি ব্যাংকে সর্বোচ্চ ২০ (বিশ) জন পরিচালক থাকতে পারে। যদি ব্যাংকের পরিচালক সংখ্যা ২০ (বিশ) জনের কম হয়, তাহলে স্বাধীন পরিচালকের সংখ্যা অন্যতম ২ (দুই) জন হতে হবে।

কারা ব্যাংকে স্বতন্ত্র পরিচালক হতে পারবেন?

কোন ব্যক্তিকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসাবে নিয়োগ দিতে হলে তাদেরকে নিচে উল্লেখিত যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে:

অভিজ্ঞতা: ন্যূনতম ১০ বছরের ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায়িক বা পেশাগত অভিজ্ঞতা।

বয়স: ন্যূনতম বয়স ৪৫ বছর এবং সর্বোচ্চ বয়স ৭৫ বছর।

শিক্ষাগত যোগ্যতা: কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি, ব্যাংকিং, ফিন্যান্স, ব্যবসায় প্রশাসন, আইন, হিসাববিজ্ঞান, Cost Accounting বিষয়ের স্নাতক/স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। ডিজিটাল ব্যাংকের ক্ষেত্রে তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে উচ্চতর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অগ্রাধিকার পাবে।

যেসকল পেশাজীবীশ্রেণী ব্যাংকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসাবে অগ্রাধিকার পাবেন:

  • সরকারি/বেসরকারি/স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের অভিজ্ঞ শিক্ষক।
  • আইন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তি।
  • হিসাব পেশায় নিয়োজিত হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে প্রফেশনাল ডিগ্রিধারী ব্যক্তি।
  • অভিজ্ঞ ব্যাংকার।
  • বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও অর্থ বিভাগ, শিল্প মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের অভিজ্ঞ কর্মকর্তা।

কারা ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক হতে পারবেন না

১) যাদের ব্যাংক বা ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সাথে অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যতে কোনো প্রকৃত বা দৃশ্যমান স্বার্থ জড়িত।

২) মনোনীত ব্যক্তির পরিবারের কোনো সদস্য যদি:
সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শেয়ার ধারণ করে।
উক্ত ব্যাংকের কোনো লাভজনক পদে নিযুক্ত থাকে।

৩) অন্য কোনো ব্যাংক, ফাইন্যান্স কোম্পানি, বীমা কোম্পানি, বা তাদের সাবসিডিয়ারি কোম্পানির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী।

৪) মনোনীত ব্যক্তি যদি:
ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হন।
জালিয়াতি, আর্থিক অপরাধ, বা অন্যবিধ অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকেন।

৫) যাদের বিরুদ্ধে কোনো দেওয়ানী বা ফৌজদারী মামলায় আদালতের রায়ে বিরূপ পর্যবেক্ষণ বা মন্তব্য রয়েছে।

৬) ব্যাংকিং বা স্বীয় পেশায় দায়িত্ব পালনকালে অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তি।

৭) কোনো পাওনাদারের প্রাপ্য পরিশোধ বন্ধ করেছেন, আপোস রফারের মাধ্যমে পাওনা আদায় হতে অব্যাহতি লাভ করেছেন, বা ঋণ খেলাপি।

৮) কর খেলাপি ব্যক্তি।

৯) আদালত কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষিত ব্যক্তি।

১০) ইচ্ছাকৃত খেলাপী ঋণ গ্রহীতা হিসেবে তালিকাভুক্ত ব্যক্তি, তালিকা থেকে অব্যাহতি প্রাপ্তির ৫ বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত।

১১) আর্থিক খাত সংশ্লিষ্ট কোনো নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের বিধিমালা, প্রবিধান, নীতিমালা বা নিয়মাচার লঙ্ঘনজনিত কারণে দোষী ব্যক্তি।

১২) এমন কোনো কোম্পানি/প্রতিষ্ঠানের মালিকানার সাথে যুক্ত ছিলেন, যার নিবন্ধন/লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে বা প্রতিষ্ঠানটি অবসায়িত হয়েছে।

ব্যাংক নিয়োগপ্রাপ্ত স্বতন্ত্র পরিচালক যে সকল সুবিধা ভোগ করবেন

ব্যাংকে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন স্বতন্ত্র পরিচালক যেসকল আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা পাবেন, সেগুলো হলো:

আর্থিক সুবিধা:

  • স্থায়ী সম্মানি: প্রতি মাসে ৫০,০০০ টাকা (প্রযোজ্য কর কর্তন সাপেক্ষে)।
  • সভা উপস্থিতির সম্মানি:
    • পরিচালনা পর্ষদের সভা: সর্বোচ্চ ০২ টি সভা, প্রতি সভায় সর্বোচ্চ ১০,০০০ টাকা।
    • নির্বাহী কমিটির সভা: সর্বোচ্চ ০৪ টি সভা, প্রতি সভায় সর্বোচ্চ ১০,০০০ টাকা।
    • অডিট কমিটির সভা: সর্বোচ্চ ০১ টি সভা, প্রতি সভায় সর্বোচ্চ ১০,০০০ টাকা।
    • ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা: সর্বোচ্চ ০১ টি সভা, প্রতি সভায় সর্বোচ্চ ১০,০০০ টাকা।

অন্যান্য সুবিধা:

  • ভ্রমণ ও হোটেল:
    • দেশের অভ্যন্তরে অন্য কোনো বিভাগীয়/জেলা শহর থেকে প্রধান কার্যালয়ে/সভাস্থলে আসা যাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ ০২ দিনের জন্য হোটেলে অবস্থান ও ভ্রমণ ব্যয় প্রাপ্য।
    • ভ্রমণ খরচ ও হোটেলে অবস্থান বিলের অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে প্রকৃত খরচের রসিদ (যেমন-ভ্রমণ টিকেট, বিমানের টিকেট, হোটেলে অবস্থানের বিল পরিশোধের রসিদ/ভাউচার ইত্যাদি) দাখিল করতে হবে।

ব্যাংকে পরিচালকের দায়িত্ব, কর্তব্য ও জরিমানা

স্বতন্ত্র পরিচালকের দায়িত্ব

  • ব্যাংক পরিচালনায় ব্যাংক-কোম্পানী আইন, ১৯৯১ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন ও বিধি-বিধানের যথাযথ পরিপালন নিশ্চিত করা।
  • ব্যাংক-কোম্পানী আইন, ১৯৯১ বা অন্য কোনো আইন/বিধি পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক লঙ্ঘন বিষয়ক যে কোনো তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংককে যথাযথভাবে অবহিত করা।
  • পরিচালনা পর্ষদের সভায় অংশগ্রহণ করা এবং উত্থাপিত এজেন্ডাসমূহের বিষয়ে সুচিন্তিত মতামত প্রদান করা।
  • পরিচালনা পর্ষদের অন্য কোনো সহায়ক কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হলে উক্ত কমিটিগুলোর সদস্যদের দায়িত্ব, কর্তব্য ও নির্দেশনাসমূহ নিষ্ঠার সাথে যথাযথভাবে পরিপালন করা।
  • পর্ষদ বা পর্ষদের বিভিন্ন সহায়ক কমিটিতে স্বতন্ত্র পরিচালকের মতামতকে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান না হলে অথবা ব্যাংক পরিচালনায় যে কোনো ধরনের অসংগতি পরিলক্ষিত হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব অফসাইট সুপারভিশনসহ ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ-কে লিখিতভাবে অবহিত করা।
  • অডিট কমিটির চেয়ারম্যান/সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা।
  • পরিচালনা পর্ষদে আমানতকারী ও সাধারণ শেয়ারহোল্ডারগণের (পরিচালক ব্যতীত) স্বার্থ সংরক্ষণে সর্বদা সচেষ্ট থাকা।

স্বতন্ত্র পরিচালকের কর্তব্য

  • ব্যাংকের সুষ্ঠু ও নিরাপদ পরিচালনা নিশ্চিত করা।
  • শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষা করা।
  • ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা তদারকি করা।
  • ব্যাংকের আইনি ও নিয়ন্ত্রক প্রবিধান মেনে চলার তদারকি করা।

স্বতন্ত্র পরিচালকের জবাবদিহিতা

  • ব্যাংক পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এবং শেয়ারহোল্ডারদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
  • যে কোনো অনিয়মিতা বা দুর্নীতির জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

স্বতন্ত্র পরিচালক পদের মেয়াদ ও অপসারণ

মেয়াদ

  • স্বতন্ত্র পরিচালকগণ সাধারণত ৩ (তিন) বছরের জন্য নিযুক্ত হন।
  • মেয়াদ শেষে, ব্যাংক-কোম্পানী আইন, ১৯৯১ এর ১৫ ধারার বিধান অনুসারে, পরবর্তী মেয়াদে নির্বাচিত হতে পারবেন।

অপসারণ

  • পরিচালনা পর্ষদ সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুরোধ করে স্বতন্ত্র পরিচালককে অপসারণ করতে পারবে।
  • স্বতন্ত্র পরিচালক নিজে ৭ (সাত) দিনের নোটিশ দিয়ে পদত্যাগ করতে পারবেন।
  • বাংলাদেশ ব্যাংক সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে যেকোনো স্বতন্ত্র পরিচালককে অপসারণ করতে পারবে।

শেষ কথা

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক জারি করা বিআরপিডি সার্কুলার নং-০৩ ব্যাংকে স্বতন্ত্র পরিচালকের ভূমিকা, নিয়োগ, মেয়াদ, অপসারণ, ক্ষমতা ও দায়িত্ব স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে। এই নীতিমালা ব্যাংকিং খাতে সুশাসন, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও নীতিমালা মেনে চলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই নীতিমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে নীতিগত দিক থেকে শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়।

Leave a Comment