চুক্তিভিত্তিক উৎপাদন প্রক্রিয়া

কামরুল হাসান নূর

Updated on:

Contract Manufacturing

পণ্যের স্বত্ত্বাধিকারী বাজারের অতিরিক্ত চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করার নিমিত্তে কোন নিবন্ধিত উৎপাদকের সহিত চুক্তির বিনিময়ে পণ্য উৎপাদন করে থাকে। এক্ষেত্রে ভ্যাট আইনে পণ্যের স্বত্ত্বাধিকারী ও চুক্তিভিত্তিক উৎপাদকের বেশকিছু আইনকানুন পালন করতে হয়। আজকের লেখায় চুক্তিভিত্তিক উৎপাদনের সংজ্ঞা, প্রয়োজনীয়তা, চুক্তিভিত্তিক উৎপাদন ও সরবরাহের পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো। যারা চুক্তিভিত্তিক উৎপাদনের সাথে জড়িত তারা সকলেই এই লেখা থেকে উপকৃত হবেন বলে আশা করা যায়।

চুক্তিভিত্তিক উৎপাদন কি? What is Contract Manufacturing

কোন নিবন্ধিত উৎপাদক কর্তৃক চুক্তির ভিত্তিতে অন্য কোন নিবন্ধিত উৎপাদকের পণ্য ( সাধারণত ব্র্যান্ডযুক্ত পণ্য ) উৎপাদনকেই চুক্তিভিত্তিক উৎপাদন বলা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক উৎপাদক পণ্যের স্বত্বাধিকারী কর্তৃক সরবরাহকৃত উপকরণ অথবা নিজস্ব উপকরণ ব্যবহার করে পণের বিনিময়ে চুক্তি ভিত্তিতে পণ্য উৎপাদন করেন। মূল্য সংযোজন কর বিধিমালা, ১৯৯১ এর বিধি-২(১) (খখ) তে চুক্তিভিত্তিক উৎপাদকের সংজ্ঞা ছিল। নতুন ভ্যাট আইনে চুক্তিভিত্তিক উৎপাদকের কোন সংজ্ঞা দেয়া হয়নি।

চুক্তিভিত্তিক উৎপাদনের প্রয়োজন কেন হয়?

কোন প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সক্ষমতার চেয়ে বাজারে তার পণ্যের চাহিদা বেশী থাকতে পারে । এ ধরনের পরিস্থিতিতে ঐ প্রতিষ্ঠান নিজ ব্যান্ডের পণ্য অন্য উৎপাদনকারীর মাধ্যমে উৎপাদন করিয়ে নিতে পারেন।

চুক্তিভিত্তিক উৎপাদন কি উৎপাদন নাকি সেবা?

চুক্তিভিত্তিক উৎপাদনকে অনেকেই সেবা হিসাবে গণ্য করেন। কিন্তু ভ্যাট আইনের ধারা -২ এর দফা (৬৫) এর ”খ” তে প্রস্তুতকরণের সংজ্ঞাতে বলা হয়েছে যে, ”পণ্যের প্রস্তুতি সম্পন্ন করিবার জন্য কোন আনুষঙ্গিক বা সহায়ক প্রক্রিয়া”। চুক্তিভিত্তিক উৎপাদক যেহেতু পন্য তৈরিতে সহায়তা প্রদান করে থাকে সেহেতু তার সরবরাহকৃত পণ্যটি অবশ্যই উৎপাদন হিসাবে স্বীকৃত হবে। অর্থ্যাৎ চুক্তিভিত্তিক উৎপাদন সেবা নয়।

চুক্তিভিত্তিক উৎপাদন প্রক্রিয়া l Contract Manufacturing Process

চুক্তিভিত্তিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় দুটি পক্ষ থাকে। ১) পণ্যের স্বত্ত্বাধিকারী ২) চুক্তিভিত্তিক উৎপাদক। এক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক উৎপাদক পণ্যের স্বত্বাধিকারী কর্তৃক সরবরাহকৃত উপকরণ অথবা নিজস্ব উপকরণ ব্যবহার করে পণের বিনিময়ে চুক্তির ভিত্তিতে পণ্য উৎপাদন করেন। চুক্তিভিত্তিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে পণ্যের স্বত্ত্বাধিকারী ও চুক্তিভিত্তিক উৎপাদক উভয়েরই স্ব স্ব করণীয় আছে।

পণ্যের স্বত্ত্বাধিকারীর করণীয়

(ক) স্বত্বাধিকারী, চুক্তিভিত্তিক উৎপাদকের সাথে The Contract Act, 1872 এর বিধান অনুসরণপূর্বক চুক্তিনামা করবেন। চুক্তিভিত্তিক উৎপাদককে প্রতি একক পণ্য উৎপাদনের জন্য কত টাকা দিবেন তা চুক্তিনামায় উল্লেখ থাকবে। পণ্যের স্বত্বাধিকারী কি উপকরণ দিবেন এবং চুক্তিভিত্তিক উৎপাদক কি উপকরণ দিবেন সবকিছুই চুক্তিতে উল্লেখ থাকবে।

(খ) স্বত্বাধিকারী মূসক-৬.৪ ব্যবহার করে উপকরণ চুক্তিভিত্তিক উৎপাদকের নিকট প্রেরণ করবেন। জারীকৃত মূসক-৬.৪ এর মূল চালানপত্র গ্রহণকারী/চুক্তিভিত্তিক উৎপাদককে দিবেন এবং অনুলিপি নিজে সংরক্ষণ করবেন। মূসক-৬.৪ জারীর ফলে কোন প্রদেয় কর উদ্ভব হবে না।

(গ) চুক্তিভিত্তিক উৎপাদক চুক্তি অনুযায়ী উৎপাদিত পণ্য সত্ত্বাধিকারীর নিকট সরবরাহ করার পর সত্ত্বাধিকারী উক্ত পণ্যের বিপরীতে উপকরণ-উৎপাদ সহগ ঘোষণা (মূসক-৪.৩) বিভাগীয় কর্মকর্তার নিকট দাখিল করবেন। পণ্যের স্বত্ত্বাধিকারী এমনভাবে পণ্যের সহগ ঘোষণা দাখিল করবেন যেন তিনি পণ্যের উৎপাদনকারী। পণ্যের সহগ ঘোষণার মধ্যে চুক্তিভিত্তিক উৎপাদক কর্তৃক উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে ব্যয় ( মেকিং কস্ট) হয়েছে তা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

(ঘ) চুক্তিভিত্তিক উৎপাদক কর্তৃক কর চালানপত্র (মূসক -৬.৩) এর মাধ্যমে সত্ত্বাধিকারীর নিকট সরবরাহকৃত পণ্যের বিপরীতে পরিশোধিত মূসক, উপকরণ কর হিসেবে রেয়াত গ্রহণ করতে পারবেন। এছাড়া, অন্যান্য উপকরণের উপর পরিশোধিত মূসক ধারা -৪৬ অনুসরণপূর্বক তিনি রেয়াত গ্রহণ করতে পারবেন।

(ঙ) মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইনের ধারা -৩৩ মোতাবেক পণ্যের স্বত্বাধিকারী পণ্য সরবরাহের লক্ষ্যে কর চালানপত্র (মূসক -৬.৩) জারী করতে পারবেন।

(চ) স্বত্বাধিকারী বিধি-৪০ অনুযায়ী নিবন্ধিত স্থানে যথাযথ হিসাব সংরক্ষণ করবেন। মূসক -৬.৪ এর মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিক উৎপাদকের নিকট উপকরণ প্রেরণের তথ্য মূসক সংক্রান্ত হিসাবপুস্তক ছাড়াও আলাদা রেজিস্টারে সংরক্ষণ করবেন।

চুক্তিভিত্তিক উৎপাদকের করণীয়

(ক) চুক্তিভিত্তিক উৎপাদক চুক্তিনামায় বর্ণিত নির্দেশনা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করার জন্য স্বত্বাধিকারী কর্তৃক মূসক-৬.৪ এর মাধ্যমে প্রেরিত উপকরণ গ্রহণ করবেন। অনেক সময় স্বত্বাধিকারী সকল উপকরণ সরবরাহ করেন। আবার কখনো দেখা যায় স্বত্ত্বাধিকারী কিছু উপকরণ সরবরাহ করেন এবং কিছু উপকরণ চুক্তিভিত্তিক উৎপাদক ক্রয় করে চুক্তিতে বর্ণিত পণ্যটি উৎপাদন করেন।

(খ) চুক্তিভিত্তিক উৎপাদক উৎপাদিত পণ্য স্বত্ত্বাধিকারীকে সরবরাহ করার পূর্বে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কর্মকর্তার নিকট উপকরণ- উৎপাদ সহগ ঘোষণা (মূসক-৪.৩) দাখিল করবেন। চুক্তি অনুযায়ী চুক্তিভিত্তিক উৎপাদক প্রতি একক পণ্য উৎপাদন বাবদ যে মূল্য গ্রহণ করবেন (মেকিং কস্ট) সে মূল্যের ভিত্তিতে সহগ ঘোষণা দাখিল করবেন।

(গ) চুক্তি অনুযায়ী স্বত্বাধিকারীকে পণ্য সরবরাহের লক্ষ্যে চুক্তিভিত্তিক উৎপাদক ধারা-৩৩ অনুসরণপূর্বক প্রাপ্য বা প্রাপ্ত পণের বিপরীতে কর চালানপত্র (মূসক -৬.৩) জারী করবেন। পণ্যের স্বত্বাধিকারীর সরবরাহকৃত উপকরণ বা চুক্তিভিত্তিক উৎপাদকের নিজস্ব উপকরণ ব্যবহার করে উৎপাদিত পণ্য চুক্তি অনুযায়ী স্বত্বাধিকারীর নিকট সরবরাহ প্রদানের লক্ষ্যে চুক্তিভিত্তিক উৎপাদক ” মূসক-৬.৪” এ দুই প্রস্থ চালানপত্র জারী করে মূল চালানপত্র পণ্যের স্বত্ত্বাধিকারীকে প্রদান করবেন এবং অনুলিপি নিজে সংরক্ষণ করবেন। পণ্য পরিবহণকালে মূল চালানপত্র যানবাহনের সাথে থাকবে। এখানে একটি বিষয় বোঝা দরকার যে, চুক্তিভিত্তিক উৎপাদনের চালানপত্র (মূসক-৬.৪) কোন কর চালানপত্র নয়। “মূসক-৬.৪” ব্যবহার করে উৎপাদিত পণ্য স্বত্বাধিকারীর নিকট পাঠানো হয়। এর ফলে কোন প্রদেয় মূসক উদ্ভব হয় না। কেবলমাত্র স্বত্বাধিকারীর নিকট হতে প্রাপ্য বা প্রাপ্ত পণ বাবদ চুক্তিভিত্তিক উৎপাদক কর্তৃক জারীকৃত কর চালানপত্রের (মূসক-৬.৩) মাধ্যমে প্রদেয় মূসকের উদ্ভব হবে।

(ঘ) চুক্তিভিত্তিক উৎপাদক “মূসক-৬.৪” এর মাধ্যমে প্রাপ্ত উপকরণ ব্যতীত কর চালানপত্র (মূসক-৬.৩)এর মাধ্যমে প্রাপ্ত বা সংগৃহীত অন্যান্য উপকরণের উপর পরিশোধিত মূসক ধারা-৪৬ অনুসরণপূর্বক রেয়াত গ্রহণ করতে পারবেন।

(ঙ) চুক্তিভিত্তিক উৎপাদক বিধি-৪০ অনুযায়ী নিবন্ধিত স্থানে হিসাব সংরক্ষণ করবেন। মূসক -৬.৪ এর মাধ্যমে সংগৃহীত উপকরণ ও চুক্তির ভিত্তিতে উৎপাদিত পণ্য স্বত্ত্বাধিকারীর নিকট ফেরত প্রদানের তথ্য মূসক সংক্রান্ত হিসাবপুস্তক ছাড়াও আলাদা রেজিস্টারে সংরক্ষণ করতে হবে।

Leave a Comment