যারা বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করতে যান বা দেশে বসে বিদেশী কোন ওয়েবসাইট থেকে কেনাকাটা করতে চান, তাদেরকে এই লেনদেনগুলো বৈদেশিক মুদ্রায় করতে হয়। আর বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কোন বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন করতে হলে তাকে অবশ্যই তার লেনদেনের জন্য তার পাসপোর্টে ডলার এন্ডোর্সমেন্ট (dollar endorsement) করে নিতে হবে। এনডোর্সমেন্ট হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় করার অনুমোদন। আজকের আলোচনায় ডলার এন্ডোর্সমেন্ট কি, কেন করবেন, কিভাবে করবেন, কত ডলার পর্যন্ত করতে পারবেন, সবকিছুই বিস্তারিত আলোচনা করবো।
ডলার এন্ডোর্সমেন্ট কি? What is dollar endorsement?
এন্ডোর্সমেন্ট মানে হল কোন কিছুর অনুমোদন দেয়া। ডলার এন্ডোর্সমেন্ট হল বিদেশী মুদ্রা ক্রয় বা বিক্রয়ের জন্য অনুমোদন সার্টিফিকেট। আপনাকে যদি বৈদেশিক মুদ্রায় কোন কিছু কেনার প্রয়োজন পড়ে তাহলে ডলার এন্ডোর্সমেন্ট করা ছাড়া আপনি ডলার কিনতে পারবেন না। আর ডলার কিনতে হলে আপনার পাসপোর্টে আপনার ক্রয়কৃত ডলারের পরিমাণ এন্ডোর্সমেন্ট করতে হবে। কারণ এই পাসপোর্টে এন্ডোর্সমেন্ট এর মাধ্যমে আপনি কোথায় থেকে ডলার ক্রয় করেছেন তা প্রমাণ করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত ডিলার, মানি এক্সচেঞ্জ বা ব্যাংক ছাড়াও অন্য কোথাও থেকে ডলার বা অন্য কোনো বিদেশী মুদ্রা ক্রয় করা বেআইনি। তাই বিদেশী মুদ্রায় লেনদেন করতে হলে আইনগতভাবে আপনাকে ডলার এন্ডোর্সমেন্ট করতে হবে।
ডলার এন্ডোর্সমেন্ট কেন করবেন?
এতক্ষণ আলোচনা থেকে আশাকরি আপনি বুঝতে পেরেছেন কেন ডলার এন্ডোর্সমেন্ট করাটা কেন জরুরী। আপনি ব্যবসা, চিকিৎসা, শিক্ষা বা বিনোদেন যে কাজেই বিদেশে যান না কেন, বিদেশে আপনার প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে হলে সেই দেশের মুদ্রা বা ডলার প্রয়োজন হবে। আর এই প্রয়োজনীয় খরচের জন্য ডলার সঙ্গে নিতে হলে আপনাকে অবশ্যই আপনার পাসপোর্টে এন্ডোর্সমেন্ট করতে হবে। আইননত, আপনি ১০,০০০ টাকার বেশি টাকা আপনার সঙ্গে করে বিদেশে যেতে পারবেন না। তাই বিদেশে খরচের জন্য আপনাকে ডলার এন্ডোর্সমেন্ট করে নিতে হবে।
কিভাবে ডলার এন্ডোর্সমেন্ট করবেন?
আগেই আমরা আলোচনা করেছি দুই ধরনের প্রতিষ্ঠান ডলার এন্ডোর্সমেন্ট করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত ব্যাংক এবং মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান। আপনি পাসপোর্ট নিয়ে গেলে পাসপোর্টের এন্ডোর্সমেন্ট পাতায় ছিল দিলে এন্ডোর্সকৃত ডলারের পরিমাণ লিখে দিবে এবং মুদ্রার বিনিময় হারে টাকার পরিবর্তে ডলার দিবে। তবে আপনি যদি ব্যাংক থেকে এন্ডোর্স করেন, তাহলে আপনি সরাসরি ডলার না কিনে আপনার ডুয়েল কারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের বিপরীতেও ডলার এন্ডোর্স করাতে পারেন।
ব্যাংক থেকে এনডোর্সমেন্ট করার প্রক্রিয়া
দেশের সরকারি বা বেসরকারি যেকোনো ব্যাংক ডলার এনডোর্স করতে পারে। ব্যাংক থেকে ডলার এন্ডোর্সমেন্ট করার জন্য আপনাকে নিম্নলিখিত ধাপগুলি অনুসরণ করতে হবে:
- আপনার নিকটস্থ অনুমোদিত ব্যাংকে যান।
- ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ডেস্কে গিয়ে ডলার এন্ডোর্সমেন্টের জন্য আবেদন করুন।
- আপনার পাসপোর্ট, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিবরণ এবং ভ্রমণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তথ্য প্রদান করুন।
- ব্যাংকের কর্মকর্তা আপনার তথ্য যাচাই করবেন। বর্তমানে অনেক ব্যাংক ডলার এনডোর্সমেন্ট করার পূর্বে আপনার ভিসা আছে কিনা চেক করে নিচ্ছে।
- তথ্য যাচাইয়ে সন্তুষ্ট হলে ব্যাংকের কর্মকর্তা আপনার পাসপোর্টের শেষ পাতায় ডলার এন্ডোর্সমেন্ট সিল মেরে দেবে। বর্তমানে ব্যাংক থেকে নগদ ডলার পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই সীমিত। তাই আপনাকে সাধারণত আপনার ডুয়েল কারেন্সি ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতেই ডলার এনডোর্সমেন্ট করতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনার কার্ডটি ব্যাংকে সাথে নিয়ে যেতে হবে।
বেসরকারি ব্যাংকে এনডোর্স করার নিয়ম
বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে এনডোর্স করার ক্ষেত্রে একটু ঝামেলা রয়েছে। কেননা লোকাল শাখাগুলোতে সাধারণত এনডোর্স করা হয় না। শুধুমাত্র এডি (অনুমোদিত ডিলার) শাখা বা ফরেইন এক্সচেঞ্জ শাখাগুলোতে এই সুবিধা নিতে পারেন। তবে লোকাল শাখাতে যদি এনডোর্স করতে যান তাহলে সেখানে আপনাকে একটা ফরওয়ার্ডিং লেটার দিতে হবে।
আপনি এই লেটারটি নিয়ে যে শাখায় এই সুবিধা পাওয়া যায়, সেখানে গিয়ে ডলার পরিবর্তন করতে পারবেন। আমার জানা মতে, প্রধান শহরগুলো ছাড়াও কিছু অন্যান্য বাণিজ্যিক এলাকায় বেসরকারি ব্যাংগুলোর এডি শাখাগুলো রয়েছে।
বেসরকারী ব্যাংকগুলো ডলার এন্ডোর্স করার ক্ষেত্রে প্রত্যেকের কিছু শর্ত রয়েছে। তাই যেই ব্যাংকেই ডলার এন্ডোর্স করতে যান না কেন, আগে থেকে তাদের শর্তসমূহ সম্পর্কে খোজঁ নিয়ে যাবেন।
মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ডলার ক্রয় করার নিয়ম
মানি এক্সচেঞ্জগুলো থেকে ডলার এন্ডোর্স করা তুলনামূলক সহজ। এখানে আপনার পাসপোর্ট নিয়েই আপনি এক্সচেঞ্জে ডলার ক্রয় করতে পারেন। ঐ দিনের রেট অনুযায়ী আপনাকে ডলার দেওয়া হবে। এক্সচেঞ্জ ফি দেয়ার বাদে আর কোনো ঝামেলা নেই।
তবে মনে রাখবেন, মানি এক্সচেঞ্জ এর ডলার এনডোর্সমেন্ট দিয়ে ভিসা আবেদন করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে না। বরং ব্যাংক স্টেটমেন্ট বা কোনো ব্যাংকের ডলার এনডোর্সমেন্ট দেখাতে হবে।
মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ডলার এন্ডোর্স না করেও ডলার ক্রয়-বিক্রয় করা যায়। যা আইনত বৈধ নয়। আবার অনেকসময় ইমেগ্রেশনে ডলার এনডোর্সমেন্ট চেক করে থাকে। তাই আপনার উচিত মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ডলার কিনলে তা পাসপোর্টে এন্ডোর্স করে নেওয়া।
কত ডলার এনডোর্স করতে পারবেন? Dollar Endorsement Limit
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী একজন পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তি বিদেশে ভ্রমণের জন্য এক বছরে সর্বোচ্চ ১২,০০০ (বার হাজার) ইউ এস ডলার বা সমমানের বৈদেশিক মূদ্রা এনডোর্স করতে পারবেন এবং ১২ বছরের কম বয়সীরা এর অর্ধেক মানে ৬,০০০ ডলার এন্ডোর্স করতে পারবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন।
ডলার এন্ডোর্সের মেয়াদ কত দিন
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী আপনার ডুয়েল কারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের বিপরীতে আপনার পাসপোর্টের যতদিন মেয়াদ ততদিন থাকবে। তবে এক্ষেত্রে শর্ত থাকে যে:
১. আপনার খরচের পরিমাণ ডলার এন্ডোর্সকৃত টাকা বা সর্বোচ্চ লিমিট অতিক্রম করবে না।
২. ডলার এন্ডোর্সমেন্ট লিমিটের অপব্যবহৃত লিমিট পরবর্তী বছর ব্যবহার করা যাবে না।
৩. প্রবাসী বা শিক্ষার জন্য বিদেশে গেলে এই সুবিধা পাওয়া যাবে না।
৪. সাপ্লিমেন্টারি কার্ডহোল্ডারও (Supplementary cardholders) একইভাবে তার পাসপোর্টে বিদেশে ভ্রমণের জন্য সমপরিমাণ ডলার এন্ডোর্সমেন্ট কোঠা ব্যবহার করতে পারবেন।
শেষকথা
বর্তমানে বাংলাদেশে ডলার সংকট থাকায় অনেক ব্যাংকই ডলার এন্ডোর্সমেন্ট করতে আগ্রহ দেখায় না অথবা এন্ডোর্সমেন্ট সম্পন্ন করতে অনেক বেশি সময় নিয়ে থাকে। অন্যদিকে ব্যাংকগুলোতে নগদ ডলার পাওয়ার সম্ভাবনাও অনেক কম। অন্যদিকে মানি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোতে আপনি নগদ ডলার পেলেও বেশ উচ্চ মূল্যে আপনাকে কিনতে হতে পারে। আবার মানি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর ডলার এর্ন্ডোসমেন্ট করার ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা আছে। তাই বিদেশ ভ্রমণের পূর্ব প্রস্তুতি হিসাবে হাতে সময় রেখেই আপনার পাসপোর্টে ডলার এন্ডোর্সমেন্ট করে নিন।