উত্তরাধিকার ক্যালকুলেটর ব্যবহার করে মুসলিম সম্পদের বন্টন বা ফারায়েজ হিসাব বের করা যায়।
কোন ব্যক্তি মারা যাবার পর তার সম্পত্তির বন্টন নিয়ে ওয়ারিশদের ভিতর জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার আমাদের দেশে খুবই সাধারণ ব্যাপার। সম্পদের বন্টন হিসাবটা একটু জটিল হওয়াতে এই বিষয়ে সবসময়ই উত্তরাধিকারদের ভিতর দ্বন্দ্ব দেখা যায়। এই জটিলতা কমাতে বাংলাদেশ সরকার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও আইসিটি বিভাগের বাস্তবায়নাধীন ‘অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট’ (এটুআই) প্রকল্পের অধীনে ‘উত্তরাধিকার ডট বাংলা’ নামের ওয়েবসাইট তৈরি করেছে যেখানে সহজেই সম্পদ বন্টন করা সম্ভব।
তাই উত্তরাধিকার ডট বাংলা ওয়েবসাইটকে সম্পত্তি বন্টন ক্যালকুলেটর বলা যায়। ওয়েবসাইটটা বাংলা ও ইংরেজী উভয় ভাষায় তৈরি করা হয়েছে। যার ফলে যেকেউ এই ওয়েবসাইট ব্যবহার করে উত্তরাধিকার ক্যালকুলেটরের মাধ্যমে উত্তরাধিকারদের মধ্যে সম্পদ বন্টনের হিসাব করতে পারবেন। এই ওয়েবসাইটে চার ধরনের সম্পত্তির বন্টনের হিসাব করা যায়। সম্পদের ধরণ সমূহ হলো: জমি, টাকা, সোনা ও রুপা
যেভাবে সম্পদ বন্টনের হিসাব করবেন? How to Use Uttaradhikar Calculator
প্রথমেই উত্তরাধিকার.বাংলা ওয়েব সাইটে প্রবেশ করুন।
ওয়েবসাইটের শুরুতেই আত্মীয়-স্বজনের তালিকা দেখতে পাবেন। এখানে যে যে উত্তরাধিকার সম্পদের ভাগ পাবে তাদের নামের পাশে সিলেক্ট করুন এবং প্রয়োজনে উত্তরাধিকারের সংখ্যাও লিখে দিন। যেমন- হয়তো পুত্রের সংখ্যা হবে ২ জন। সেক্ষেত্রে পুত্র সিলেক্ট করার পর পুত্রের পাশের ঘরে ২ লিখে দিন।
সম্পদের বিবরণ ঘরে জমি, স্বর্ণ, রৌপ্য ও নগদ টাকার পরিমাণ উল্লেখ করুন। জমি পরিমাণ দিবেন শতাংশ হিসাবে, স্বর্ণ ও রৌপের পরিমাণ দিবেন ভরি হিসাবে।
এবার নিচে ফলাফল লেখাতে ক্লিক করলে মুহুর্তে কোন আত্মীয় কতটুকু সম্পদ পাবেন তা টেবিলে ও পাই চার্টের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হবে এবং কিভাবে সম্পদের ভাগ হলো সেই রেফান্সেও দেওয়া থাকবে। প্রয়োজনে আপনি সম্পদ বন্টনের হিসাবটি প্রিন্ট করে নিতে পারেন।
কোন আইনে সম্পদের বন্টন হিসাব করা হয়?
মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে সম্পদের উত্তরাধিকারদের দুই ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথমত জবিউল ফুরুজ (নিকট আত্মীয়) ও দ্বিতীয়ত আসাবা বা অবশিষ্টভোগী। প্রতিটা উত্তরাধিকার কখন কত অংশ সম্পদের ভাগ পাবেন তা মুসলিম আইনে বিস্তারিত বলা হয়েছে।
জবিউল ফুরুজ কাদেরকে বলা হয়?
জবিউল ফুরুজ বলতে বোঝায় এমন কিছু আত্মীয় যারা মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে নির্দিষ্ট অংশ পায়। তাদের অংশের পরিমাণ কোরআনে স্পষ্টভাবে বলা আছে।
জবিউল ফুরুজ মোট ১২ জন, যার মধ্যে ৪ জন পুরুষ এবং ৮ জন মহিলা।
৪ জন পুরুষ হল – (১) স্বামী, (২) পিতা , (৩) দাদা , (৪) সৎ ভাই (বৈপিত্রেয়)।
নির্ধারিত অংশের পরিমান নিম্নরূপঃ – (১) স্ত্রী , (২) কন্যা , (৩) পুত্রের কন্যা , (৪) মাতা, (৫) দাদি এবং নানি , (৬) সহোদর বোন, (৭) সৎ বোন (বৈমাত্রেয়), (৮) সৎ বোন (বৈপিত্রেয়)।
সম্পত্তি বণ্টন প্রক্রিয়া
নির্ধারিত অংশের পরিমান নিম্নরূপঃ
(১) স্বামী ১/৪ পাবে যখন সন্তান বা পুত্রের সন্তান থাকে।
(২) স্বামী ১/২ পাবে যখন সন্তান বা পুত্রের সন্তান না থাকে।
(৩) স্ত্রী ১/৮ পাবে যখন সন্তান বা পুত্রের সন্তান থাকে।
(৪) স্ত্রী ১/৪ পাবে যখন সন্তান বা পুত্রের সন্তান না থাকে।
(৫) কন্যা ১/২ পাবে যখন একজন মাত্র কন্যা থাকে এবং পুত্র না থাকে।
(৬) কন্যা ২/৩ পাবে যখন দুই বা ততধিক কন্যা থাকে এবং পুত্র না থাকে।
(৭) কন্য অবশিষ্ট ভোগী হিসাবে পাবেন যখন এক বা একের অধিক পুত্র থাকে।
(৮) পুত্রের কন্যা পাবে ১/২ অংশ পাবে যখন একজন মাত্র পুত্রের কন্যা থাকে। যদি কোন পুত্র, পুত্রের পুত্র বা একের অধিক কন্যা এবং পুত্রের কন্যা না থাকে।
(৯) পুত্রের কন্যা ২/৩ ভাগ পাবে যখন দুই বা ততধিক পুত্রের কন্যা থাকে এবং পুত্র ও পুত্রের পুত্র এবং এবং একের অধিক কন্যা না থাকে।
(১০) পুত্রের কন্যা অবশিষ্ট ভোগী হিসেবে পাবেন। পুত্রের পুত্র না থাকলে সমান অংশ কা আইন অনুযায়ী।
(১১) পিতা ১/৬ অংশ পাবে পুত্র বা পুত্রের পুত্র থাকে।
(১২) পিতা ১/৬ অবশিষ্ট অংশ ভোগী হিসেবে পাবে যখন এক বা একরে অধিক কন্যা, পুত্রের কন্যা এবং পুত্রের পুত্র না থাকে।
(১৩) পিতা অবশিষ্ট অংশ ভোগী হিসেবে পাবে যখন পুত্র বা পুত্রের পুত্র থাকে।
(১৪) মাতা ১/৬ অংশ পাবে যখন পুত্র ও পুত্রের পুত্র এবং দুই বা ততধিক ভাই বোন এবং পিতা থাকে।
(১৫) মাতা ১/৩ অংশ পাবে যখন পুত্র অথবা পুত্রের পুত্র এবং একের অধিক ভাই বোন না থাকে।
(১৬) মা ১/৩ অংশ পাবে যখন স্ত্রী, স্বামী এবং বাবা থাকে। s
(১৭) দাদা ১/৬ অংশ পাবে যখন সন্তান এবং পুত্রের সন্তান থাকে এবং পিতা বা নিকটতম পিতামহ না থাকে।
(১৮) দাদা অবশিষ্ট অংশ ভোগী হিসেবে পাবে ১/৬ অংশ পাবেন যখন কন্যা অথবা পুত্রের কন্যা থাকে।
(১৯) দাদা অবশিষ্ট অংশ ভোগী হিসেবে পাবে যদি দূরবর্তী কোন অংশিদার বা অকশিষ্ট অংশ ভোগী না থাকে।
(২০) দাদী ১/৬ অংশ পাবেন যদি কোন মাতা বা মায়ের দিকে দাদী না থাকে।
(২১) পূর্ণ বোন ১/২ অংশ পাবেন যখন একজন মাত্র বোন থাকে এবং যদি কোন সন্তান, পুত্রের সন্তান, পিতা অথবা ভাই না থাকে।
(২২) পূর্ণ বোন ২/৩ পাবে যখন দুই বা ততধিক বোন থাকে এবং সন্তান, পুত্রের সন্তান, পিতা ও ভাই না থাকে।
(২৩) বোন অবশিষ্ট ভোগী হিসেবে পাবে যখন পূর্ণ ভাই থাকে বা এক বা একাধিক পুত্রের কন্যা থাকে এবং বোনকে বঞ্চিত করার মত কোন অংশিদার না থাকে এবং এক বা একাধীক কন্যাদের সহিত অবশিষ্ট ভোগী থাকে তারা কন্যাদের অংশ নেওয়ার পর অবশিষ্ট ভোগী হবে।
(২৪) বৈমাত্রীক বোন পাবে ১/২ অংশ যখন একজন মাত্র বোন থাকে এবং সন্তান, সন্তানের সন্তান এবং পিতা ও পূর্ণ ভাই বোন না থাকে।
(২৫) বোন পাবে ২/৩ অংশ যখন দুই বা ততধিক বৈমাত্রীক বোন থাকে এবং সন্তান, সন্তানের সন্তান এবং পিতা ও পূর্ণ ভাই বোন না থাকে।
(২৬) বৈমাত্রীয় বোন পাবে ১/৬ ভাগ যখন একজন পূর্ণ বোন থাকে (বোন পাবে ১/২ এবং বৈমাত্রী বোন পাবে ২/৩, ১/২, ১/৬)।
(২৭) বৈমাত্রীয় বোন অবশিষ্ট অংশ ভোগী হিসেবে পাবে যখন কোন বৈমাত্রীয় ভাই, এক বা একাধিক কন্যা এবং পুত্রের কন্যা এবং বঞ্চিত করার মত কোন অংশিদার না থাকে।
(২৮) বৈমাত্রীয় ভাই ১/৬ অংশ পাবে যখন সুধু মাত্র একজন বৈমাত্রীয় ভাই থাকে এবং সন্তান, পুত্রের সন্তান ও পিতা না থাকে।
(২৯) বৈপিত্রীয় ভাই ১/৩ অংশ পাবে যখন সেখানে দুই বা ততধিক বৈপিত্রীয় ভাই থাকে এবং সন্তান, সন্তানের সন্তান এবং পিতা না থাকে।
(৩০) বৈপিত্রীয় বোন ১/৬ অংশ পাবে সেখানে একমাত্র বৈপিত্রীয় বোন থাকে এবং সন্তান, সন্তানের সন্তান এবং পিতা না থাকে।
(৩১) বৈপিত্রীয় বোন ১/৩ অংশ পাবে যখন সেখানে দুই বা ততধিক বৈপিত্রীয় বোন থাকে এবং সন্তান, সন্তানের সন্তান এবং পিতা না থাকে।
আসাবা কাদেরকে বলা হয়?
(১)। আসবা গণের চারটি শ্রেণী আছেঃ
শ্রেণী (১): (১)) পুত্র , (২))কন্যা , (৩))পুত্রের পুত্র, (৪)) পুত্রের কন্যা
শ্রেণী (২): (১))পিতা , (২))দাদা
শ্রেণী (৩): (১))সহোদর ভাই, (২)) সহোদর বোন, (৩))সৎ ভাই (বৈমাত্রেয়), (৪))সৎ বোন (বৈমাত্রেয়), (৫))সহোদর ভাইয়ের পুত্র, (৬))সৎ ভাই(বৈমাত্রেয়)-এর পুত্র, (৭))সহোদর ভাইয়ের পুত্রের পুত্র , (৮)) সৎ ভাই(বৈমাত্রেয়)-এর পুত্রের পুত্র ।
শ্রেণী (৪): (১))চাচা, (২))চাচা (বৈমাত্রেয়), (৩))চাচাতো ভাই, (৪))চাচাতো ভাই (বৈমাত্রেয়), (৫))চাচাতো ভাইয়ের পুত্র, (৬))চাচাতো ভাই (বৈমাত্রেয়) এর পুত্র , (৭))চাচাতো ভাইয়ের পুত্রের পুত্র, (৮))চাচাতো ভাই (বৈমাত্রেয়)এর পুত্রের পুত্র
(২)। শুধুমাত্র পুরুষ অথবা মহিলা আসাবা হিসাবে থাকলে, অবশিষ্টাংশের সম্পুর্ণ অংশ পুরুষ অথবা মহিলা পাবেন, কিন্তু একই শ্রেণীর পুরুষ ও মহিলা একত্রে আসাবা হিসাবে থাকলে, পুরুষ ও মহিলাগণ ২:১ অনুপাতে অবশিষ্টভোগী হবেন।
সম্পত্তি বণ্টন প্রক্রিয়া
ধাপঃ (১) – প্রথমে সম্পত্তি জবিউল ফুরুজ দের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে।
ধাপঃ (২) – জবিউল ফুরুজ দের অংশ সমূহ যোগ এর পরে সম্পূর্ণ অংশটি ১ এর চেয়ে বেশী হলে, সকল অংশ আনুপাতিক হারে কমে আসবে যাতে সম্পূর্ণ অংশটি ১ হয়।
ধাপঃ (৩) – যদি কোন আসাবা না থাকেন এবং সম্পূর্ণ অংশ ১ এর চেয়ে কম হলে স্বামী স্ত্রী এর অংশ ছাড়া জবিউল ফুরুজ অংশ সমূহ আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাবে যাতে মোট অংশটি ১ হয়। স্বামী/স্ত্রী এর অংশ কঠিনভাবে সুনির্দিষ্ট করা।
ধাপঃ (৪) – আসাবা থাকলে অবশিষ্ট অংশ আসাবাগন পাবেন নিম্নের ক্রম অনুযায়ী পাবেনঃ
ধাপঃ (১) >ধাপঃ (২)>ধাপঃ (৩)>ধাপঃ (৪)
(শ্রেণী ১ থাকলে পরের শ্রেণীর আসাবাগন সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবেন ,শ্রেণী ২ থাকলে পরের শ্রেণীর আসাবাগন সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবেন; এভাবে চলতে থাকবে)
আমাদের শেষকথা
উত্তরাধিকার ডট বাংলা একটি যুগান্তকারী ওয়েবসাইট যা সম্পত্তি বন্টনের জটিলতা দূর করতে এবং ওয়ারিশদের মধ্যে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ওয়েবসাইটটি ব্যবহার করে আপনি আপনার পরিবারের মধ্যে সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও ন্যায্য সমাধানে পৌঁছাতে পারবেন।