আমাদের দেশে প্রচলিত ট্রেডমার্ক আইন, ২০০৯ এবং আন্তর্জাতিক চুক্তির বিশেষ কিছু নিয়ম অনুসরণ করে বাংলাদেশ সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর ট্রেডমার্ক নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে পারেন। নির্ধারিত ফরমে যেকোন ব্যক্তি ট্রেডমার্ক নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে পারেন। প্রাথমিকভাবে আবেদন থেকে নিবন্ধন পর্যন্ত ধাপ চারটি আর সরকারি ফি পরিশোধ করতে হয় তিনটি ধাপে।

ট্রেডমার্ক আবেদন ও নিবন্ধন করার প্রক্রিয়া

শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর ট্রেডমার্ক যথাযথ ফরমে নির্ধারিত আবেদন ফি জমা দিয়ে ট্রেডমার্ক আবেদন করে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়। কিভাবে ট্রেডমার্ক আবেদন ও নিবন্ধন তা ধাপে ধাপে এই পর্বে আমরা আলোচনা করবো।

ধাপ-০১: আবেদন

ট্রেডমার্ক নিবন্ধনের জন্য অনলাইনে বা পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরে নির্দিষ্ট আবেদন ফরম বা টিএম-০১ ফরমে মালিকানা আছে এমন যে কেউই নিজে অথবা আইনজীবীর মাধ্যমে আবেদন করতে পারবেন। উক্ত ফরমটি download করে যথাযথভাবে কম্পিউটারে ৪(চার) সেট পূরণ করতে হবে। পূরণকৃত ফরম যথাযথ ফি এবং প্রয়োজনীয় দলিলাদিসহ পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরে (৯১, মতিঝিল বা/এ, ঢাকা) নিচ তলায় অবস্থিত তথ্য ও সেবা কেন্দ্রে জমা দিতে হবে। তথ্য ও সেবাকেন্দ্রে সঠিকভাবে পূরণকৃত প্রাপ্ত আবেদনপত্র আবেদনকারীর ক্রমিক নম্বর সহ একটি প্রাপ্তি স্বীকারপত্র দিবেন। উল্লেখ্য যে, চট্টগ্রাম বিভাগের আবেদন এ দপ্তরের চট্টগ্রামস্থ শাখা অফিসে (কক্ষ নং-২১৮, সরকারি কার্য ভবন-১, আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম) জমা দিতে হবে। আবেদন ফরম পূরণ করা ও জমা দেওয়ার বিস্তারিত নিয়মাবলী নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

১) ISO A4 সাইজ এবং অনূন্য ৮০ জি এম এস কাগজে আবেদন ফরম পূরণ করতে হবে।

২) শ্রেণীর বিবরণ: পৃথক পৃথক শ্রেণীভুক্ত পণ্য বা সেবার ক্ষেত্রে পৃথক পৃথক আবেদন করতে হবে এবং আবেদন ফরমের নির্ধারিত স্থানে পণ্য/সেবা কোন শ্রেণীভুক্ত তা উল্লেখ করতে হবে। কোন ধরণের পণ্য বা সেবা কোন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত তা NICE Classification উপলিংকে পাওয়া যাবে।

৩) মার্ক বা লেবেলের বিবরণ: লেবেল আঁটানোর জন্য আবেদনপত্রের নির্ধারিত স্থানে পরিমিত সাইজ ও টেকসই কাগজের লেবেল আঠা দিয়ে লাগাতে হবে। লেবেল হিসেবে কোন মোড়ক/প্যাকেট/ফটোকপি গ্রহণযোগ্য নয়। লেবেলের মধ্যে কোন প্রার্থীত ট্রেডমার্ক তা সুনির্দিষ্টভাবে (TM) চিহ্নিত করে দিতে হবে। ‍উপযুক্ত প্রমাণাদি ছাড়া লেবেলে (R) , BSTI, ISO বা এ ধরণের কোন সংস্থার লোগো থাকতে পারবে না। লেবেল/লোগোতে বাংলা/ইংরেজী ব্যতীত অন্য কোন ভাষা থাকলে আবেদনপত্রের ৬নং কলামে তার Translation এবং Transliteration দিতে হবে। লেবেল/লোগোতে কোন ব্যক্তির ছবি ব্যবহৃত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির/অভিভাবকের অনাপত্তি পত্র জমা দিতে হবে।

৪) আবেদন ফরমের ৩নং কলামে মার্কের বর্ণনা দাখিল করতে হবে।

৫) পণ্য/সেবার বিবরণ: আবেদন ফরমে নির্ধারিত স্থানে পণ্য/সেবার বিবরণ দিতে হবে।

৬) আবেদন ফরমের ৭নং কলামের ক অংশে ব্যক্তির নাম ও তথ্যাবলী (Proprietorship এর ক্ষেত্রে) এবং খ অংশে কোম্পানির নাম ও তথ্যাদি (Ltd. কোম্পানির ক্ষেত্রে) উল্লেখ করতে হবে। আবেদনকারী কোম্পানি হলে কোম্পানিটি কোন আইনে গঠিত তা উল্লেখ করতে হবে। যেমন- A company organized and existing under the laws of Bangladesh.

৭) আবেদন ফরমের ৭নং কলামের গ অংশে কোম্পানির ব্যবসার ধরণ জানতে হবে। যেমন-প্রস্তুতকারক, আমদানিকারক, সেবাদানকারী।

৮) আবেদন ফরমের ৭নং কলামের ক অথবা খ অংশে আবেদনকারীর পত্র যোগাযোগের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা উল্লেখ করতে হবে।

৯) আবেদন ফরমের ১০নং কলামে প্রার্থীত মার্কের সুনির্দিষ্ট তারিখসহ ব্যবহারকালে উল্লেখ করতে হবে। প্রার্থীত মার্কটি ইতোমধ্যে ব্যবহৃত না হয়ে থাকলে উক্ত স্থানে “Proposed to be used” লিখতে হবে।

১০) আবেদন ফরমের নির্ধারিত স্থানে আবেদনকারীর পূর্ণ নাম, স্বাক্ষর, পদবী, ই-মেইল, মোবাইল/টেলিফোন নম্বর উল্লেখ করতে হবে।

১১) আবেদনকারী ‘Priority Claim’ করলে তার সমর্থনে প্রয়োজনীয় দলিলাদি দাখিল করতে হবে এবং আবেদনের ১১ নং কলামে যথাযথভাবে পূরণ করতে হবে।

১২) মার্কের স্বত্বাধিকারী নিজে বা তার আইনজীবী বা তালিকাভুক্ত এজেন্ট এর মাধ্যমে আবেদনপত্র দাখিল করতে পারবেন। আইনজীবী বা তালিকাভুক্ত এজেন্ট এর মাধ্যমে আবেদনপত্র দাখিল করলে মূল/সত্যায়িত GPA/PA (TM-10) ফরমে যথাযথ স্ট্যাম্পসহ (GPA এর ক্ষেত্রে ১০০০/-, PA এর ক্ষেত্রে ৫০০/-) দাখিল করতে হবে।

১৩) আবেদন ফি (একটি শ্রেণীর এক বা একাধিক ধরণের পণ্য/সেবার ক্ষেত্রে ৩৫০০/-) রেজিস্ট্রার, ডিপিডিটি এর অনুকুলে যেকোন তফসিল ব্যাংকের বিপরীতে পে-অর্ডার/ব্যাংক ড্রাফট এর মাধ্যমে দাখিল করতে হবে।

১৪) আবেদন দাখিলের পূর্বে আবেদনকারী চাইলে, প্রার্থীত মার্কটি ইতোমধ্যে কোন পণ্য/সেবার ক্ষেত্রে নিবন্ধিত/আবেদিত কিনা তা নির্ধারিত ফিসহ (১০০০/-) TM-4 ফরমে আবেদন দাখিলের মাধ্যমে ২ (দুই) সপ্তাহের মধ্যে জানতে পারবেন।

বিদেশী আবেদনকারীদের ক্ষেত্রে অবশ্যই এজেন্টে/আইনজীবীর মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। ট্রেডমার্ক নিবন্ধন আবেদনের জন্য যেসকল কাগজপত্রাদি জমা দিতে হয়:

১. চিহ্ন / লোগো / ডিভাইস প্রিন্ট বা উপস্থাপনার নাম

২. আবেদনকারীর নাম

৩. আবেদনকারীর ঠিকানা

৪. আবেদনকারীর ধরণ: যেমন-মার্চেন্ডাইজার, উৎপাদনকারী/সেবা সরবরাহকারী

৫. পণ্য / সেবা এবং শ্রেণীর নির্দিষ্টকরণ

৬. চিহ্ন / লোগো / ডিভাইস প্রিন্ট ব্যবহারকারীর তারিখ (যখন বাংলাদেশে ব্যবহার বা প্রস্তাবিত হয়)

৭. পাওয়ার অব অ্যাটর্নি (প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে)

আবেদন ফি: ৩৫০০ টাকা এবং ১৫% ভ্যাট

ধাপ-০২: আবেদন পরীক্ষা

আবেদনের তথ্য ও আবেদনকৃত চিহ্ন / লোগো / ডিভাইস প্রিন্টটি পূর্ববর্তী আবেশিত বা নিবন্ধিত কোন চিহ্ন / লোগো / ডিভাইস প্রিন্টের সাথে কোন মিল আছে কিনা তা পরীক্ষা করেন ট্রেডমার্ক পরীক্ষক। যদি উক্ত চিহ্ন / লোগো / ডিভাইস প্রিন্টের কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয় তাহলে ট্রেডমার্ক পরীক্ষক টিএমআর-১২ ফরমে আবেদনকারীকে উহা অবহিত করবেন। সেক্ষেত্রে আবেদনকারী নিজে বা তার নিয়োগকৃত আইনজীবীর মাধ্যমে শুনানির দাবী করিতে পারবেন। দাখিলকৃত জবাব বা শুনানি সন্তোষজনক বা কোনরকম ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত না হয় তাহলে আবেদনকারীর মার্কটি ট্রেডমার্ক জার্নালে প্রকাশের জন্য TMR-5 নোটিশ প্রেরণ করা হয়।

ধাপ-০৩: জার্নাল প্রকাশ

জার্নাল প্রকাশের অনুপতি প্রাপ্তির পরে আবেদনকারীকে জার্নালে প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় ফি প্রদান করতে হয়। আবেদনকারী নোটিশ প্রাপ্তির ০১ (এক) মাসের মধ্যে জার্নাল ফি প্রদান না করলে প্রার্থীত মার্কটি নোটিশ প্রদানপূর্বক পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। যথাযথ জার্নাল ফি প্রদান করলে প্রার্থীত মার্কটি জার্নালে বি.জি প্রেসে মুদ্রনের জন্য TM-9 ফরমে প্রেরণ করা হয়। জার্নালে প্রকাশের পরে যদি দেশ-বিদেশের কোন ব্যক্তি বর্ণিত মার্কের বিষয়ে ক্ষুব্ধ বা সাংঘর্ষিক মনে করেন তাহলে মার্কটি ট্রেডমার্ক জার্নালে প্রকাশে ২ মাসের মধ্যে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি (বিশ্বের যে কোন প্রান্ত থেকে) নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিরোধিতার আবেদন (অপোজিশন কেস) দাখিল করতে পারবেন। মামলার ফলাফল নিবন্ধন আবেদনকারীর বিপক্ষে গেলে নিবন্ধনের আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করা হবে এবং ফলাফল নিবন্ধন আবেদনকারীর পক্ষে হলে নিবন্ধন প্রদানের লক্ষ্যে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।

জার্নাল প্রকাশের জন্য ফি: ১০০০ টাকা এবং ১৫% ভ্যাট।

ধাপ-০৪: নিবন্ধন

জার্নাল প্রকাশের পরে যদি কোন বিরোধিতার আবেদন না থাকে অথবা বিরোধীপক্ষের মামলার রায় আবেদনকারীর পক্ষে আসে তাহলে বর্ণিত মার্কটি  TM-11 ফরম এর মাধ্যমে নির্ধারিত ফি জমাদানের মাধ্যমে ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রি-ভুক্ত হবে এবং আবেদনকারী এইমর্মে একটি রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট লাভ করবেন। ট্রেডমার্কটি আবেদনের পরে রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ আবেদনের তারিখ হতে ৭ বছর এবং পরবর্তী প্রতি ১০ বছর অন্তর অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত (এমনকি উত্তরাধিকার সূত্রে) উহা নবায়ন করা যাবে। নবায়ন ফি ট্রেডমার্কটি মেয়াদপূর্তির আগে (তবে ৬ মাস পূর্বে নয়) পরিশোধ করতে হবে। মেয়াদপূর্তির পরে তবে চারমাসের মধ্যে বিলম্ব ফি এর মাধ্যমে TM-17 ফরমে পুনরায় আবেদন করা যাবে।

রেজিস্ট্রেশন ফি: ১৫০০০ টাকা এবং ১৫% ভ্যাট।

শেষ কথা

ট্রেডমার্ক নিবন্ধন আপনার ব্র্যান্ডের সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উপরে বর্ণিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আপনি সহজেই আপনার ট্রেডমার্ক আবেদন ও নিবন্ধন করতে পারেন।

Show CommentsClose Comments

Leave a comment